#শিবপুরাণেও_দেবী
“এই লম্পটকে রক্ষা করবে যাতে আমার জাহ্নবীপ্রিয় পতি অন্য নারীকে প্রবেশ করিয়ে উপভোগ করতে না পারে।” [শিবপুরাণ, ধর্ম সংহিতা ১০/৩৪]
কেউ না জানলেও স্ত্রী ভালো করে জানে স্বামীর চরিত্র কেমন।
শ্রীমদ্ভাগবতে হরপার্বতী একত্র উপবিষ্ট থাকা সত্ত্বেও বিষ্ণুর মোহিনী মূর্তি দেখে মহাদেব বিচলিত হয়েছিলেন। সমুদ্র মন্থনে উত্থিত অমৃতের অংশ থেকে অসুরদের বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে বিষ্ণু অপরূপা মোহিনী রূপ ধারণ করে অমৃত অপহরণ করে দেবতাদের দিয়েছিলেন। এই সময়ে বিষ্ণুর মোহিনী মূর্তি দর্শন করে মহাদেব সংযম হারিয়ে পার্বতী ও প্রমথগণের সম্মুখেই মোহিনীর অনুসরণ করেছিলেন। ভাগবতের ভাষায়,
“এইরূপে সেই শোভানাঙ্গী দর্শনীয়া মনোহারিণীকে দেখে মহাদেব সেই সজ্জাহীনাতে মনোনিবেশ করলেন। তার দ্বারা জ্ঞান অপহৃত হওয়ায় মদনবিহ্বল হয়ে ভবানীর চক্ষুর সম্মুখেই লজ্জাহীন হয়ে তাকে অনুসরণ করলেন। সেই বিবস্ত্রা অতিমাত্রায় লজ্জিতা সুন্দরী তাকে আসতে দেখে হাসতে হাসতে বৃক্ষের অন্তরালে আত্মগোপন করে পালাতে লাগলেন। ভগবান ভব ইন্দ্রিয়সকল উন্নসিত হওয়ায় কামপরবশ হয়ে যূথপতি যেমন করিণির পশ্চাৎ ধাবিত হয়, সেইরূপ তার অনুগমণ করতে লাগলেন।” [ভাগবত ৮/১২/২৪-২৭]
বাঙালি কবিরাও শিবকে কামুকরূপে চিত্রিত করেছেন। ভরত চন্দ্রের শিব তো কামদেবকে ভস্ম করেই কামবাণে পীড়িত হয়ে নারী খুঁজে বেড়ান-
“মরিল মদন তবু পঞ্চানন
মোহিত তাহার বাণে।
বিকল হইয়া নারী তলাসিয়া
ফিরে সকল স্থানে।
[অন্নদামঙ্গল কাব্য]
মঙ্গল কাব্যের শিব কোচনী ডোমিনীর সঙ্গ লাভে ঘুরে বেড়ান। হরগৌরী পরিণয়ের পরে শিব যখন গৌরীকে নিজের অর্ধাঙ্গ করে নিতে চাইলেন, তখন গৌরী বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গীতে শিবকে বলেছিলেন-
নিজ অঙ্গ যদি মোর অঙ্গে মিলাইবা
কুচনীর বাড়ি তবে কেমনে যাইবা।।
[অন্নদামঙ্গল কাব্য]
মুকুন্দ রামের চন্ডী মঙ্গলে ভিক্ষুক শিবকে কোচরমণীগণ পুরাতন নাগর বলে চিনতে পেরে আহ্লাদে গদগদ হয়ে ওঠে-
যতেক কোচের মেয়্যা হরের বারতা পেয়্যা
ভিক্ষা দিতে আইল তখন।
পুরাতন দেখি হরে কাচলি অসম্বরে
কুচযুগে না দেই বসন।
দশ পাঁচ সখি মেলি, শিবের বসন ধরি
কেহ বা টানয়ে পরিহাসে।
বসি কুচনীর পাশে শিব নিরানন্দে ভাসে
যুবতী বুঢারে নাঈ বাসে।।
[চণ্ডীমঙ্গল কাব্য]
রামেশ্বর শিবায়নে শিব ভিক্ষার নিমিত্ত মনোহর বেশে কোচের নগরে প্রবেশ করেন- শিঙ্গা বাদনে মন্ত্রোচ্চারণে কোচ যুবতীদের আকর্ষণ করে নিয়ে এলেন, কোচনীদের সঙ্গে মদন-রঙ্গে (মদন মানে কামদেব) মেতে উঠলেন।
গায় শিঙ্গা দ্রুত আয় আয় কোচবধূ ।
আকরষণহেতু মন হরি করি করি ধ্যান।
জপে মন্ত্র যুবতী জীবনে পড়ে টান।।
বিকল হইয়া টুটে সকল কোচিনী
শিব আইল আইল হইল মহাধ্বনি।।
ধাইল কোচিনী শুনি বিশাল ঘোষণা
মুকুন্দ মুরলী রবে যেন গোপাঙ্গনা।।
শুধু কোচিনী নয়, বাগদী রমনীর প্রতিও শিবের আকর্ষণ কম নয়। বাগদিনীর ছদ্মবেশিনী গৌরীর জন্য ভিক্ষুক শিবের ব্যাকুলতা হাস্যরসের উদ্রেক করে।
হাস্যা হাস্যা ঘেস্যা ঘেস্যা ছুতে যায় অঙ্গ
বাগদিনী বলে আই মা এ আর কি রঙ্গ।।
বুড়া মুড়া মনুষ্যা হয়্যা কেমন কর সয়্যা।
মন মজিল পারা মাঠে পায়্যা পরের মায়্যা।।
দেব দেব বলে মোরে দয়া কর সই।
বাগদিনী বলে আমি তেমন মায়্যা নই।।
মহাকবী কালিদাস কুমার সম্ভব কাব্যে হর পার্বতীর বিহার বরণ্না করেছন। [কুমারসম্ভব ৭ম সর্গ]
সুতরাং এমন শিব যে বিদ্রুপের পাত্র হবে তাতে আর সন্দেহের কি আছে? ভারতচন্দ্রের কাব্যে তো বালকগণ শিবের প্রতি বিদ্রুপ-বাণ বর্ষণ করেছে। এমনকি ধূলোও ছুঁড়েছে-
কেহ বলে ওই এল শিব বুড়া বাপ।
কেহ বলে বুড়াটি খেলাও দেখি সাপ।।
কেহ বলে জটা হৈতে বার কর জল।
কেহ বলে জ্বাল দেখি কপালে অনল।।
কেহ বলে ভালো করে শিঙ্গাটি বাজাও।
কেহ বলে নাচ দেখি গলা বাজাইয়া।
ছাই মাটি কেহ গায় দেয় ফেলাইয়া।।
কেহ আনি দেয় ধুতুরার ফুলফল।
কেহ দেয় ভাঙ পোস্ত আফিংগ গরল।।
[শিবের ভিক্ষাযাত্রা অন্নদামঙ্গল]
শুধু ভারতচন্দ্র নয়, পুরাণকারও বিদ্রূপ করে শিবের গায়ে ধূলো ছুঁড়েছেন-
“কেউ কেউ তাকে উপহাস করলো, কেউ ভর্ৎসনা করলো, কোনো কোনো উন্মত্ত দ্বিজ তার গায়ে ধূলো ছুড়লো, অপর বলগর্বিত ব্যক্তি উপহাস করতে করতে ইষ্টক ও লগুর দ্বারা প্রহার করতে লাগলো। অন্য ব্রাহ্মণ বালকগণ জটা ধরে কাছে টেনে এনে জিজ্ঞাসা করছে- ব্রত সমাপন তোমাকে কে শিখিয়েছে- এখানে অনেক স্ত্রীলোক আছে তাদের জন্যই তুমি এসেছ। কোন পাপী গুরু তোমাকে এই পথ দেখিয়েছে?”[পদ্ম