গোমাংস’ শব্দটি শুনলেই আজকাল অধিকাংশ হিন্দুরা আঁতকে ওঠেন। গোমাংস তাদের কাছে নিষিদ্ধ এক বস্তু। তাই গোমাংস খাওয়ার অপরাধে ভারতে হয়ে চলেছে হত্যা, নির্যাতন। গরু নিয়ে ভারতের রাজনীতি এখন সরগরম। গো রক্ষার জন্যে গঠিত হয়েছে নানান দল। ভাগ্যচক্রে পশু গরু এখন হয়ে উঠেছেন গোমাতা!
কিন্তু ইতিহাস বলে হিন্দুরা আগে গোমাংস খেত। তাহলে কেন তারা গোমাংস খাওয়া বন্ধ করলো? কিভাবে হিন্দুদের গোমাংসের জোগান দেওয়া আদিম গরু আজকের গোমাতা হয়ে উঠলো?
এ সবই বিস্ময়কর রহস্যে আবৃত। সেই রহস্য ভেদ করা দুরূহ, দুঃসাধ্য। তবুও সেই রহস্যের যবনিকা সরানোর অদম্য ইচ্ছাতেই এই লেখাটি লিখছি।
বৈদিক আর্যরা মাংস খেত এবং তাদের দেবতাদের উদ্দেশ্যেও তা উৎসর্গ করতো। ঋগবেদে অশ্ব পাক করার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে –
“হে অশ্ব! অগ্নিতে পাক করার সময় তোমার গা দিয়ে যে রস বেরোয় এবং যে অংশ শূলে আবদ্ধ থাকে, তা যেন মাটিতে না পড়ে ও ঘাসের সঙ্গে মিশে না যায়। দেবতারা লালায়িত হয়েছেন, তাদের দেওয়া হউক।“ ১/১৬২/১১
“যে কাষ্ঠদণ্ড মাংসপাক পরীক্ষার্থে আণ্ডে দেওয়া হয়, যে সকল পাত্রে ঝোল রক্ষিত হয়, যে সকল আচ্ছাদন দ্বারা উষ্ণতা রক্ষিত হয়…এরা সকলেই অশ্বের মাংস প্রস্তুত করছে।“ ১/১৬২/১৩
“ যারা চারদিক থেকে অশ্বের মাংস রান্না দেখছে, যারা বলছে যে গন্ধ মনোহর হচ্ছে- এখন নামাও, যারা মাংস পাবার জন্য অপেক্ষা করছে তাদের সঙ্গে আমাদের সংকল্প এক হউক” ১/১৬২/২
ঋগ্বেদে মহিষ হত্যা ও রান্না করার উল্লেখও বারংবার পাওয়া যায়। প্রধান দেবতা ইন্দ্র বৃত্রাসুরকে বধ করবার জন্য অত্যন্ত বিখ্যাত হয়ে আছেন। বৃত্রকে হত্যাকারী ইন্দ্রের সেই কীর্তি বারবার বেদে ও পরবর্তী ধর্মগ্রন্থসমূহে
“হে ইন্দ্র! যখন তুমি মহিষের মাংস ভক্ষণ করেছিলে , যখন ঐশ্বর্য সম্পন্ন তিনপাত্র সোমরস তুমি পান করেছিলে, তখন তিনি বৃত্র সংহার করেছিলেন, তখন সমস্ত দেবতা সোমপানকারী ইন্দ্রকে ভৃত্যবৎ যুদ্ধস্থলে আহ্বান করেছিলেন।“
ঋগবেদ ৬/১৭/১১ এ দেবতা পূষা ও বিষ্ণুকে ইন্দ্রের জন্য শত মহিষ পাক করতে বলা হয়েছে-
“হে ইন্দ্র! অখিল মরুৎগণ সম্প্রীতিভাজন হইয়া তোমাকে স্তোত্র দ্বারা বর্ধিত করে , তোমার জন্য পূষা ও বিষ্ণু শত মহিষ পাক করুন এবং মদকর শত্রুনাশক সোম পূর্ণ তিনটি নদী প্রবাহিত হউক।”
ঋগবেদ ৫/২৯/৭ এ উল্লেখ আছে অগ্নি ইন্দ্রের জন্য তিনশত মহিষ পাক করেছিলেন-
“ইন্দ্রের মিত্রভূত অগ্নি স্বীয় মিত্র ইন্দ্রের কার্যে সহায়তা করিবার জন্য সত্বর তিনশত মহিষ পাক করিলেন; এবং ইন্দ্র বৃত্র বধের জন্য মনুপ্রদত্ত সোমরস এককালে পান করিলেন।“
অন্যান্য পশুর পাশাপাশি গোহত্যা ও গোভক্ষণও বৈদিক যুগে বহুল প্রচলিত ছিল।যদিও বৈদিক মানুষদের কাছে গরু নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী বলে বিবেচিত হত। গরু অর্থে ‘গো’ শব্দটি ঋগ্বেদের পারিবারিক মণ্ডলে ১৭৬ বার [1] এসেছে এবং গবাদি পশু সম্পর্কিত শব্দসমূহ মোটামুটি ৭০০ বার [2] এসেছে। বৈদিক যুগে একজন ধনী লোককে গোমত বলা হত।[3] গোত্রের প্রধানকে বলা হত গোপ বা গোপতি । গরুর জন্য অনেক যুদ্ধও সংঘটিত হত। তাই গভিষ্টি[4], গব্যু[5] , গবেষণ[6] এর মত যুদ্ধবাচক শব্দগুলো গবাদি পশু হতে এসেছে। কন্যাকে বলা হত দুহিতা ( যে দুধ দোয়ায়) । এমনকি অনেক দেবতাদের উৎপত্তিও গরু থেকে দেখানো হয়েছে, তাদের গোজাত[7] বলা হত।
#সংগৃহীত